শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

তুই তো বেডা হইয়া গেছস

আকাশে প্রচন্ড মেঘ করেছে। রওশন আরা তার কোমড়, উরুর প্রচন্ড ব্যাথা নিয়েও বিছানা থেকে নিজেকে টেনে নামালেন। উঠানের রোদে দেওয়া ধান গুলো এখনই না তুললে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে গেলে এই ধান নিয়ে তাকে আবার বিপাকে পড়তে হবে। রুখশানা বাড়িতে থাকলে তবুও একটু সাহায্য করতে পারতো। মেয়েটা ক্লাসে সব পড়া পারে তারপরও কেন যে পরীক্ষায় আশানুরুপ ফলাফল করতে পারছে নাতা রওশন আরার মাথায়ই আসে না। অথচ এ ব্যাপারে রুখশানার কোন বিকার নেই। স্কুল থেকে ফিরে স্কুলের ড্রেস না খুলেই দরজা বন্ধ করে দেয় এক ঘুম। ডাক দিতে গেলে কান্না জড়িত কন্ঠেই খেকিয়ে উঠে। কি করবে?! যাওয়ার সময় বাবার সঙ্গে কখনো সখনো মোটর বাইকে করে স্কুলে গেলেও নিয়মিত যাওয়া আসায় ৩ মাইল করে ৬ মাইল পথ হেটেই পারি দিয়ে দেয়। কখনো পথে অচেনা যুবকদের ঈভ টিজিংতো আছেই। যদিও হেড মাস্টারের মেয়ে বলে সবাই একটু সমীহ করেই কথা বলে। কিন্তু অচেনা যুবকদের কেইবা জানাবে যে, উঠতি যৈবনা, রুপসী রুখশানা হেডমাস্টারের মেয়ে। গুনী রুখশানা মায়ের আগ্রহেই এর মধ্যে টেইলারিং-এর কাজটা শিখে নিয়েছে। ঘরের টুকটাক সেলাই আর ঘরে পড়ার পোষাকগুলো নিজেদের পা-মেশিনেই বানিয়ে ফেলে। বিভিন্ন শো-পিছ বানাতেও সে ওস্তাদীর পরিচয় দেয় আর সেই সাথে মায়ের ১০ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেও কাছের বন্ধু-প্রতিবেশি মহলে বেশ নাম কামিয়ে নিচ্ছে। রুখশানার খুব শখ বাবার মতো শিক্ষক হবে। কিন্তু শিক্ষক হতে গেলে তো তাকে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতেই হবে। তবেই আশা করা যায় সামনের সময়গুলোকে ঠিক মতো কাজে লাগানোর। কিন্তু গোড়াতেই গলদ হয়ে গেলে আর এগুবে কি করে! রুখশানার বাবা তারেক সরকার এলাকার সবচেয়ে বড় বিদ্যালয় কদমতলী হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। যেহেতু চাকুরী জীবনে সুনাম আছে, টাকার জোর সাথে রাজনৈতিক সুবিধা পাবে আর এম.এড-এ প্রথম শ্রেণী আছে তাতে তার ভারপ্রাপ্ত পদটা স্থায়ী পদে শিগগীরই রুপান্তরিত হয়ে যাবে। কিন্তু যতো কিছুই হোক রওশন আরা কোনভাবেই নিজের দূর্দশাগ্রস্থ জীবনের ছায়া তার মেয়ের উপর দেখতে চায় না। শহরের স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় এক ঈদে কাজিনের সাথে রিক্সা করে ঘুরতে বেরিয়ে ছিলো। কপালে শনি ছিলো, নইলে পরিবারের স্বজনেরা কেন যে রওশন আরাকে ভুল বুঝে এসএসসি পরীক্ষার মাত্র ৩ মাস আগে গ্রামের এক ধনীর বি.এ পড়ুয়া দুলালের কাছে বিয়ে দিয়ে দেয় তার হিসেব রওশন আরা আজো মিলাতে পারে না। কাজিনের সাথে ঘুরতে যাওয়া আর পালিয়ে যাওয়া যে এক বিষয় না তা রওশন আরার স্বজনরা এতোগুলো বছর পরও বুঝতে চায় না।ফলাফল যা হবার তাই হলো। এসএসসিতে এক বিষয়ে ক্র্যাশ করলো।ফলে কমপ্লিমেন্টারী দিয়ে পার হলেও শহরের সরকারী কলেজে ভর্তি হতে না পেরে এক অখ্যাত কলেজে ভর্তি হলো এবং দূর্দশা যেন নিত্য সাথি হয়ে গেল রওশন আরার। এইচএসসি পাশ করলেও ফলাফল ভালো হলো না। আর তখন বাধ্য হয়ে শ্বশুরবাড়ী এলাকার কলেজে বি.এ ভর্তি হলো। সহপাঠী ফ্যাশনেবল জেরিনের সাথে সখ্যতা গড়ে না উঠলেও পরিচয় তখন থেকেই। এর মধ্যে এক বাচ্চা এবরশন করলেও রুখশানা পেটে চলে এলে বন্ধ হয়ে যায় রওশন আরার গ্র্যাজুয়েট হবার স্বপ্ন। অথচ এই শহুরে রওশন আরাই এক সময় শিশু একাডেমিতে চোখ ধাধানো সব ছবি আকঁতো। স্বপ্ন দেখতো ঢাকার আর্ট কলেজে পড়ার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রওশন আরা উঠানে কয়েকভাগে মেলে রাখা ইরি, আটাশ আর তেইশ ধান গুলো তোলা শুরু করলো। পাইজম আর নাজিরশাইল পেতে পেত এই আটাশ আর তেইশ দিয়ে ঘরের মানুষগুলোর ভাতের চাহিদা মিটে যায়। শহুরে মা, বোন, ভাবীদেরও সে বস্তা ভরে ভাতের চাল আর পিঠার চাল পাঠায় নিজের খুশিতেই। প্রকৃতি যেন মুচকি হেসে ব্যঙ্গ করলো। সবগুলো ধান ভাগ ভাগ করে বারান্দায় তুলে গরু-বাছুর আনতে গেলে ততক্ষণে মেঘ সরে আবার আকাশ ঝকঝকে সূর্য যেন হাসি দিয়ে উপহাস করলো। পেছন পেছন সারে তিন বছরের আদরের ধন আরিফ। গরু-বাছুরের দড়ি গুলোকে আবার মাঠে খুঁটি গেড়ে উঠানে এলো ধান নাড়তে। শরীর আর চলছে না, টেনে টেনে আবার সব ধান মেলে দিয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়লো। ব্যস্ত হেডমাস্টার হেড মাস্টার তারেক সরকার এমন কোন রাত যায় না যেই রাতে সে তার স্ত্রীর কাছ থেকে তার জৈবিক চাহিদা পূরণ করে নেয়। নারীর প্রাকৃতিক নিয়মে সীমাবদ্ধ নিষিদ্ধ সময়গুলোতেও সে তার স্ত্রীকে বাধ্য করে ভিন্ন উপায়ে তার চাহিদা পূরণে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর অনেক রাতেই রওশন আরার স্বামীর এসব জৈবিক চাহিদা মেটাতে যেয়ে স্বামীকে পাষন্ড মনে হয়। ইদানিং স্বামীর চাহিদা পূরণ করার পর রওশন আরা খেয়াল করছে তার সতীপথ দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ব্যস্ত স্বামীকে যদি এই কথা বলে তবে "সারা বছরের রোগী" এই অপবাদ শুনতে হয়। স্বামী তারেক সরকার রাতে তার চাহিদা মেটানোর পর ইদানিং শুরু করেছে আরেক নাটক। সারারাত কার সঙ্গে যেন কথা বলে। লুকিয়ে একদিন মোবাইল চেক করে রওশন আরা হতবাক। তারই সহপাঠী সেই ফ্যাশনেবল জেরিন যে এখন অন্য একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করছে। এই কয় বছরে জেরিনকে নিয়ে অনেক পুরুষকে জরিয়েই অনেক বাজে কথা কানে এসেছে। কিন্তু নিজের স্বামীর সংশ্লিষ্টতার কথা ভাবতেই শিউরে উঠে রওশন আরা। একদিন জিজ্ঞেস করায় নিজেকে ফেরেশতা প্রমাণ করতে স্বামীর কঠিন ধমকে মিইয়ে গিয়ে পরে আর কোন প্রশ্ন করার সাহস হয়নি রওশন আরার। কিন্তু লোকমুখে ফিসফিসানী একসময় রওশন আরার কানে আসে। স্বামীর চাহিদা বেড়ে গেছে। সে এখন ডিভোর্সড জেরিনের কাছে যায় তার বেড়ে যাওয়া চাহিদা পূরণ করতে। যদিও এক সময়ের স্বামীর বাগানের সুবাস ছড়ানো গোলাপ ফুল রওশন আরা কখনও ত্রুটি করেনি স্বামীর চাহিদা পূরণে কিন্তু এখন আর তার হিসেব মেলে না। রাগ করে যে বাপের বাড়ি চলে যাবে সে উপায়ও নেই। বাপের বাড়ির মানুষগুলো তাদের পুরনো ভুল এখনও বুঝে আছে। এর মধ্যে নিজেই একদিন মোড়ের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায়। ওরা চৌরাস্তার বড় ক্লিনিকে যেতে বলে। পরদিন স্বামীকে অনেক হাতে -পায়ে ধরে বড় ক্লিনিকে যায়। ভায়া (VIA) টেস্ট করতে বলে ডাক্তার। পরীক্ষা করে ফলাফল আসে রওশন আরা জরায়ু মুখের ক্যান্সারে কঠিন ভাবে আক্রান্ত। ডা. লতিফ তারেক সরকারকে জিজ্ঞেস করে জেরিনের সুস্থ্যতার কথা। রওশন আরা কিছু বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে। বহুগামী জেরিনের যে জরায়ু মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে একথা তারেক সরকার চেপে যেতে চেয়েও পারে নি। এর মধ্যে গ্রামের মহিলাদের কাছে প্রচার হয়ে গেছে রওশন আরার জরায়ু কেটে ফেলতে হবে। জেরিনের কাছ থেকে জৈবিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে এই রোগের জীবানু তারেক সরকার স্ত্রীতে স্থানান্তরিত করে দিয়েছে। VIA টেস্টের রেজাল্ট জানার পর তারেক সরকার যেন আরও হিংস্র হয়ে উঠে। যখন তখন হাত উঠে রওশন আরার গায়ে। কখনো কখনো লাথি দিয়েও ফেলে দেয় এই বলে যে, সে কোন বেটা ছেলের সাথে এক বিছানায় ঘুমাবে না। গভীর রাত, বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ফোনে আলাপরত তারেক সরকারের এমনি এক লাথ্থিতে নিচে পড়ে যেয়ে রওশন আরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। আকাশের জলও যেন হার মানছে তার চোখের জলের কাছে। শুধু কানে ঝমঝম করে বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে তার কানে বাজছে স্বামীর কথাটা " তুইতো বেডা হইয়া গেছস" শব্দের অর্থ: আর্ট কলেজ=চারুকলা VIA= Visual Inspection of Cervix with Acetic Acid

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites