সোমবার, ২১ মে, ২০১২

বিশ্বাসঘাতক!



গত ফেব্রুয়ারী মাসে বড় আপার শ্বশুরবাড়ী গিয়েছিলাম, পঞ্চগড়ের বোদায়।এটা বড় আপার প্রথম শ্বশুরবাড়ী ভ্রমণ, তাই আমাকেও সাথে নিল।বড় আপা খুব এক্সাইটেড ছিলো প্রথম শ্বশুর বাড়ী ভ্রমণে।

তারপরের কথাগুলো বড় আপা যা বলেছে তা হুবহু তুলে দিলাম

...শ্বশুরবাড়ীতে ওয়েলকাম কিভাবে জানাবে তা নিয়ে একটু অসস্তিতে ছিলাম। যখন বাড়ির কাছে পৌঁছলাম তখন সবই বেশ হাসি মুখে রিসিভ করতে এলো। প্রথম দফাতেই ভালো লেগে গেল। ভেতর বাড়িতে ঢুকতে বইরেএকটা পুকুর ঘাট, বাঁশঝাড়, কবরস্থানএসব পাড় হয়ে তার পর ভেতর বাড়িতে যেতে হয় কিন্তু যখন পুকুরপার দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন কেমন যেন শীত শীত করছিলোএকটু বেশিই! পাত্তা দেইনি ব্যাপারটায়। ভেতর বাড়িতে যাওয়ার পর কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে, নাস্তা সারার পর মুরুব্বীরা শ্বশুরের কবর জিয়ারত করতে নিয়ে গেলেনযা কি না বাশ ঝাড়ের পাশেই, আর তার একটু অদূরেই সেই শীত লাগা পুকুর টা! কবর জিয়ারত করে মনটা খুব খারাপ লাগছিলো, বাসার ভেতরে যাওয়ার জন্য যখন অন্যদের তাড়া খাচ্ছিলাম তখন আমার খুব ইচ্ছে করছিলো পুকুর পাড়টাতে বসতে।
পারলাম না অন্যদের তাড়া খেয়ে। কিন্তু মনটা পড়ে রইলো পুকুর ঘাটে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে আর আমি টের পাচ্ছি আমার ভেতর কেমন যেন অস্থিরতা পেয়ে বসছে! পুকুরটা বড্ড টানছে আমায়।একবার যেতে নিলাম, বাশঝাড় পাড় ওয়ার সময় কেমন যেন শিরশির লাগছিলো। পুকুর ঘাটে যেয়ে বসলাম, মনে হলো যেন ইয়ের সাথে বসেছি গল্প করতে। বর হন্তদন্ত হয়ে খুজে আমায় ভেতরে নিয়ে গেল। খাওয়া দাওয়া শেষে কিছুক্ষণ গল্প হলো শ্বশুর বাড়ির পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে। কিছুক্ষণ টিভিও দেখা হলো।এরপর সবই যার যার মতো ঘুমাতে চলে গেল। আমি বরের পাশে শুয়ে আছি, খুব রোমান্টিক সময় কাটার কথা। কিন্তু আমি কোনভাবেই মনযোগ দিতে পাচ্ছি না। বরকে বললাম , "চল পুকুর ঘাটে যেয়ে বসি", বর কিছুটা বোঝানোর সুরে বললো এই মুহুর্তে যাওয়াটা বেমানান দেখায়। কিন্তু আমি ততক্ষণে ভেতরে একধরণের অস্থিরতা বোধ করছি। বর ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে বিছানা থেকে উঠে আসতে নিলাম, কিন্তু ঘুমের মধ্যেই সে আমার হাত টেনে ধরলো! এরপর বেশ কিছুক্ষণ মরার মতো পড়ে রইলাম। বর ঘুমিয়েছে নিশ্চিত হয়ে বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরুলাম, আকাশে চাদের ম্লান আলো কেমন যেন এক বিষন্ন পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। ঘরগুলো পার হয়ে এবার বাশঝাড়,এদিক সেদিক তাকিয়েএগিয়ে যাচ্ছি। কেমন যেন শিহরণ লাগছে, হঠাৎ করেই দূরে দেখলাম সাদা শিফনের মতো শাড়ী গায়ে, পিঠ ছাপিয়ে চুল ঘোমটার ভিতর দিয়েও দেখা যাচ্ছে। আমি অবাক হলাম!এতো ছিপছিপে গড়নের সাদা শিফনের শাড়ী গায়ে রমনী আমাকে অদ্ভুত ভাবে তার পেছনে টানছে। আমি তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম। আশ্চর্য! সে এতো রাতে পুকুরে নামছে কেন??!একসময় কান্নার শব্দে শরীররটা পানিতে ডুব মারলো! ততক্ষণে আমি ঘাটের কাছে চলে এসেছি। পেছন থেকে কেউ আমায় হ্যাচকা টান মারলো। বর!!!! তাকেতো ঘুমের মধ্যে রেখে এসেছি! সেই! পাশে না দেখে খুজতে বেরিয়েছে।
ঘরে গেলাম, আমার ঘাম ছুটছে, আবার প্রচন্ড শীত করছে। কেমন যেন অসহায় লাগছিলো। তোর কথা মনে পড়ে গেল। ডুকরে কেঁদে উঠলাম। বর মুখ চাপা দিয়ে বললো, কি করো? সবাই কি ভাববে?! আমি ভোরের অপেক্ষা করতে করতে রাত পার হয়ে গেল।
তখনও তুই ঘুমাচ্ছিস। আমি প্রথমে বড় জা কে বললাম গতরাতের ঘটনা!উনি চোখ বড় করে আঁতকে উঠাটাকে লুকাতে চাইলেন। গেলাম আরও তিন/চারজনের কাছে। সবাই কেমন যেন আঁতকে উঠে ঢোক গিলে।বুঝতে পাচ্ছি কিছুএকটা ব্যাপার আছে। কিন্তু কেউ মুখ না খুললে বুঝবো কেমন করে। গেলাম বড় জেইয়ার কাছে। বেশ দূর্বল হয়ে গেছেন, ফজরের নামায শেষ করে যায়নামাযে বসে তসবী জপছিলেন। ওকা মতো পেয়ে পাশে যেয়ে সালাম করে বসলাম।উনি স্নিগ্ধ হাসিটা ছড়িয়ে দিলেন। যখন গতরাতের ঘটনা উনাকে জিজ্ঞেস করে কেঁদে ফেললাম, উনি বিব্রত হয়ে গেলেন। বললেন, "বৌমা, তোমার কি এটা না জানলেই না?" আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, "জেইয়া, পুকুর তো আমাকে টানছে!" এই কথা শুনে উনার মুখটা আমসি হয়ে গেল। আমি উনার বিবর্ণ মুখটা দেখতে পেলাম ...বললেন

"একযুগ পরে বৌ যে কেন তোমাকেই দেখা দিলো সেটাইতো অবাক লাগছে!"

আমি ধাক্কা খেলাম "বৌ?!"

উনি বললেন, এই বাসায় গত ১২ বছরে আরো ৪ জন বৌ এসেছে, কিন্তু দীপালি বৌমাতো তাদের কাউকেই দেখা দেয়নি!!!!


নিঃস্ব পৃথিবীঃ
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠার পর আপুর কাছে যেয়ে দেখি আপু ঘুমাচ্ছে, ঠিক ঘুমাচ্ছে বলা যাবে না, চোখ বুজে পড়ে আছে। আপুর বড় জাআপুর কপালে পানি পট্টি দিচ্ছে। কপালে হাত দিয়ে দেখি জ্বরে পুরে যাচ্ছে আপুর শরীর, চোখের কোনা দিয়ে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে জল। ওই ভাবী আমাকে দেখে আপুর কাছে থাকতে বলে কাজে গেলেন। আমাকে দেখে আপু শক্ত করে আমার হাতটা ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো ঐশী, ভালোবেসে কাওকে কোনদিন বিশ্বাস করিসনা। তাহলে যতোদিন বেঁচে থাকবি ততোদিন জ্বলে পুরে মরবি। আমি ভাবছিলাম আপু হয়তো জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে। কিন্তু তখনও বুঝিনি কি ঘটতে চলছে। রাতে এককোনায় আমি, মাঝখানে আপু আর আরেকপাশে আপুর বরের শোবার ব্যবস্থা হলো। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা, কিন্তু হঠাৎ চাপা হিসহিস শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আপু দুলাভাইয়ের সাথে চাপা গলায় ঝগড়া করছে। সারমর্ম যা বুঝলাম, দুলাভাইয়ের অফিসের "নাদিয়া" নামের কোন নারী কলিগকে নিয়ে কোন একটা সমস্যা। ঠিক বুঝতে পাচ্ছিলাম না, আপুর সন্দেহ নাকি আসলেই দুলাভাইয়ের কোন সমস্যা আছে। মাথাটা চিনচিন করে উঠলো। তবুও নিরবে পড়ে রইলাম এবং আবার কখন যে মরার ঘুমে ঘুমিয়ে পরেছিলাম, ঘুম ভাঙলো ঘরের বাইরে চিৎকার চেঁচামেচিতে! ভেতরটা ছেৎ করে উঠলো, পাশে আপু দুলাভাই কেউ নেই। কিন্তু সকাল হতে ঢের দেরী আছে। হুরমুর করে বেরুলাম। সবাই এই শেষ রাতে পুকুর পারে! আমার মাথা কাজ করছে না। আপু আমাকে গতকালই বলেছিলো ওই পুকুরের ঘটনাটা!
এই মুহুর্তে পরের অংশটুকু লিখতে আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। চোখের পানি সামলেও রাখতে পাচ্ছিনা। আমি এতো বড় কষ্ট নিয়ে পঞ্চগড় থেকে এতোটা পথ পারি দিয়ে কি করে ঢাকা ফিরে যাবো?! যেই আপু আমাকে নিয়ে এসেছিলো সেই আপুর সাথে ফিরে যেতে পারলাম না। আমার পৃথিবীটা নিঃস্ব হয়ে গেছে। এতো দ্রুত একা হয়ে যাবো ভাবতেও পারিনি। আপু, কেন আমায় বললিনা তোর সব কষ্টের কথা?! আমি কি পারতাম না কোনভাবে তোর কষ্ট দূর করতে? অন্তত আমায় চেষ্টাতো করতে দিতি? কেন এভাবে চলে গেলি?!


ঢাকায় ফেরার পর বাবা-মা দুলাভাইয়ের নামে কেস করতে চাইলেন, কিন্তু আপু নিজে যেখানে নিজেকে আত্নাহুতি দিয়েছে সেখানে আত্নীয়-স্বজনরা বাবাকে নিরুৎসাহিত করলো এই বলে যে এটাতো মার্ডার না।


শরীর সর্বস্ব:

ঢাকায় ফিরে দীপালী ভাবীর বাবার বাসা খুঁজে পেতে একটু কষ্টসাধ্যই হয়ে গেল। কারণ আপুর শ্বশুর বাড়ীর কেউ নাম্বার দিতে চায় না। শেষে আপুর সেই বড় জেঠা শ্বশুরকে ফোন করে কান্নাকাটি করে নম্বর যোগার করলাম।
১২ বছর আগের কাহিনী, কিন্তু দিপালী ভাবীর বাসায় যেয়ে তা বোঝার উপায় নেই। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে ভাবীর বিয়ে হয়েছিল, তখনকার উচ্ছলতায় ভরা ফটো ঘরময় টাঙানো। ভাবীর মারা যাওয়ার কোন তথ্য উনাদের বাসার কেউ দিতে পারেনি। তবে শ্বশুর বাড়ী থেকে বলা হয়েছিল সাঁতার না জানার কারণে পুকুরে নেমে আর উঠতে পারেনি।

দিপালী ভাবীর স্বামী আপুর মেঝো ভাসুর। খুঁজে বনশ্রী তার বাসায় গেলাম। যখন সেখানে যেয়ে পৌঁছলাম, তখন সেই নওরোজদার বাসায় উনার সাথে উনার সুদর্শন এক বন্ধু গল্প করছিলেন। আমাকে দেখে চুপ মেরে হাসিমুখে তাকালেন। তাদের চেহারা দেখে বয়স বুঝতে না পারলেও হিসেব করে দেখলাম প্রায় ৪২/৪৩ হবে। কিন্তু অবাক লাগছিলো তাদের আকর্ষণীয় ফিগার আর জ্বলজ্বলে চেহারা দেখে। এই বয়সেও এতো আকর্ষণীয় সত্যিই ঈর্ষণীয়!

কয়েকদিন তাদের দুজনের কাছ থেকেই সময় পেতে যেয়ে অবাক হয়ে খেয়াল করছিলাম নওরোজদার বন্ধু অর্থাৎ তমাল ভাইয়ের সাথেই আমার ভাব হয়ে যাচ্ছে! এবং উনি একসময় কথাচ্ছলে আমার সাথে অদ্ভুত সব ঘটনা শেয়ার করা শুরু করেছেন। আমিও কেমন যেন মোহগ্রস্থের মতো উনার কথাগুলোর একনিষ্ঠ শ্রোতা হয়ে গেলাম।

তমাল ভাই আমার কাছে একেক করে সব স্বীকার করেছেন। নওরোজদার একের পর এক মেয়েদের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার পেছনে, ঢাকা শহরের ব্রোথেলগুলোর খোঁজ পেতে তমাল ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা। তারা অফিসিয়াল ট্যুরগুলোকে কতো নিঁখুত ভাবে কাজে লাগাতেন তাদের প্রতিটা দিনের শেষে রাতকে। সেখানকার মেয়েদের শরীর দিয়ে তাদের ক্লায়ান্টদের যত্ন করার বর্ণনা শুনে সত্যিই নিজেকে সামলানো কষ্টকর হয়ে গিয়েছিলো। ট্যুর শেষে ফিরে এসে তাদের খাবারের চাহিদা বেড়ে যেত। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার নাম করে মেয়ে গুলো নওরোজদাএবং তাদের মতো কাস্টমারদের শরীরের চাহিদা ভালোই মেটাতো।
দিপালী ভাবী কোনভাবে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। যদিও নওরোজদার ব্যক্তিত্বের সামনে যে কারো দাড়ানোই মুশকিল। ভাবী ঢাকা কিছু প্রমাণ করতে পারেন নি।কিন্তু যখন শ্বশুরবাড়ী গেলেন তখন সেখানকার এক কুমারী মাতার কাহিনী দূর্ঘটনাক্রমেই জেনে গেলেন। যেই জাকিয়ার সন্তান কিনা নওরোজদার ঔরষজাত। চাপা একটা কষ্ট নিয়ে শ্বশুরবাড়ী যেয়ে এই ঘটনা জানার পর নিজেকে আর সামলাতে পারেননি। ঢাকায় ফিরে বাবা-মাকে হয়তো এই কষ্টের ভাগীদার করতে চাননি। তাই নিজেকে সেই পুকুরের পানিতেই তলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগে জেঠা মশাইকে বলে গিয়েছিলেন যেন ভাবীর বাবা-মাকে নওরোজদার চরিত্রের ব্যাপারে কিছু জানতে না দেয়।

লেখকের মতামতঃ
সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে মানুষ যদি শরীর
 সর্বস্ব হয়ে যায়, তবে তার মানুষ না হয়ে পশু হয়ে পৃথিবীতে আসা উচিত। 

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites