শনিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১২

দীর্ঘশ্বাসের ঈদ!

ফুট ওভারব্রীজ পার হতে যেয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে।চৈতিকে এই পুরো মাসে একবারও এ পথ দিয়ে আসতে হয়নি। অস্থির লাগছে। এবার একটা ঝটপট রিক্সা পেলে বেঁচে যায়। আজব! পরিবাগ থেকে মৌচাক চল্লিশ টাকা চায়! টাকা কি গাছে ধরে নাকি?! ত্রিশ টাকার নিচে কেউতো যেতে চাচ্ছে না! শেষ পর্যন্ত যাই হোক এক জনের সাথে ২৫ টাকায় দফারফা হলো। সে সাধারণ অভ্যাস বশতই হুড টেনে দিতে চাইলো।

না, লাগবে না, রাখেন
বলে তাকে থামালো।
মোবাইলে ব্লগ দেখা ছেড়ে দিয়েছে বন্ধুরা চিল্লাচিল্লি করে বলে। কিন্তু এতোটা পথ রিক্সায় পার হওয়াও  আরেক কষ্টের ব্যাপার। তবে দেখতে ভালোই লাগে যখন কোন যুগল কেমন উরু উরু, খুশি খুশি মুডে উড়তে উড়তে রিক্সা দিয়ে যায়। মেয়েদের চেহারাগুলো খেয়াল করে ওদের মনের কথা বুঝতে চাওয়ার এই অভ্যাসে মাঝে মাঝে চৈতি নিজেই অবাক হয়ে যায়। মনে হয় ও যেন ওদের মনের কথা পড়তে পাচ্ছে। পায়ে হেঁটে শাড়ি পড়া শুকনো জিরজিরে এক মেয়ে গেল। কাঁধের ব্যাগ আর চেহারা দেখেই বোঝা গেল চাকুরী থেকে ফিরছে। কেমন যেন অস্থির লাগে চৈতির। মেয়েটি ওর মাথায় ঢুকে গেছে।আচ্ছা ওর স্বামী ওর এই মনমরা চেহারা দেখেই তৃপ্ত?! খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে একান্তে মেয়েটার সাথে। স্বামীরা হচ্ছে আজব প্রজাতির! ওরা বউটিকে সারাদিন খাটতে দেখে সুখ পায় আবার বউকে যথাযথ পরিপাটি হয়েও থাকতে হবে।আরে ব্যাপার আছে না, অফিসের গাল্লুগুল্লু ভোদাই মার্কা চেহারার সাবর্ডিনেটটিও যে যথেষ্টই পরিপাটি হয়ে থাকে।ইয়াং বসকে ভাইয়া ভাইয়া বলে জান কোরাবান করে দেয়। অথচ বাসায় ফিরে বউয়ের এহন মনমরা বাসি চেহারা দেখতে কারই বা ভালো লাগে।
হঠাৎ করেই মোবাইলে রিং বেজে উঠে,

-কি রে, কৈ তুই?
ঃ বাইরে
-বাইরে কৈ?
এই এক জ্বালা, তোমরা বাপু এ্যানোনিমাস থাকতে চাও আবার আমাগোরে খুঁচাইয়া খুঁচাইয়া কেন জিগাও?! আজব! মেজাজটা খারাপ হতে চেয়েও হয় না।
ঃ পরীবাগ রে
-এই বিকালে পরীবাগ কি করোস?
ঃাল, তোর লাইগা অপেক্ষা করি
ওপাশ থেকে হেব্বি ক্ষেপে গেছে
-দেখ চৈতি, আমার সাথে এইরকম কইরা কথা কইবি না
 তো , কিরকম কইরা কথা কমু, জান!
-এইভাবে কথা কইলে তোর সাথে কথা কওয়ার কোন মানে হয় না!
ঃ আরে ধুর! ক্ষেপস ক্যান, তোরে ক্ষেপাইয়া যে মজা পাওয়া যায় তার মজাই অন্য রকম ;)
-এই, আমি একটু পরে তোরে ফোন দিতাছি, একটা জরুরী কল আইছে।

চৈতি একাই কতোক্ষণ হাসলো। সাবির, খুব সহজেই ক্ষেপে যায়। আর ওরে ক্ষেপিয়ে মজাও বেশ। সামনের দিকে তাকালো রমনা থানা পার হয়ে মসজিদটা পার হচ্ছে রিক্সাওয়ালার দিকে খেয়াল করেনি এতোক্ষণ ভালোভাবে । হায় হায়! এ কি অবস্থা! চোখ আটকে গেছে-



নিজেকে কেমন অসহায় লাগছে! গলার কাছে কষ্টেরা দলা পাকিয়ে উঠছে। একটা শার্ট কিনতে পারে না! নিজেকে বোঝাতে কষ্ট হচ্ছে! মাহিনের কতো শার্ট আলমারিতে এমনিতেই পরে। আছে কয়দিন পর হয়তো গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিবে। তার থেকে একটা শার্ট দিলেওতো বেচারার কতো কাজে লাগতো। অন্তত রিক্সা চালানোর সময় না হলেও বউকে বাইরে নিয়ে যাবার সময়তো অন্তত পড়তে পারতো। আহা বউকেই কি কখনো বাইরে নিতে পারে নাকি! চৈতি নিজেই নিজেকে ধিক্কার দেয়। অস্থির লাগছে বড্ড।পিৎজা হাট, কেএফসি বা সরমা হাউজগুলোর কথা ভাবতেই মনটা তেতো হয়ে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে ওর। কিন্তু এই চৈতিই কি মনে রাখবে, কোথাকার কোন রিক্সাওয়ালার গায়ে জামা নেই।গন্তব্যে পৌঁছে ওর দিকে না তাকিয়েই পঁচিশ টাকার জায়গায় ত্রিশ টাকা দিয়ে চৈতি নিজেকে পৌচাশিক সান্তনা দিলো। হ্যাঁ, তাইতো। বাড়তি পাঁচ টাকায়তো আর ওর শার্ট কেনা হবে না। 
গন্তব্যে পৌঁছে কাজ সেরে যেতে হবে বেইলী স্টারে।মাহিন টেক্সট করছে, 
-kotokkhon lagbe?
coming
-ok, baily star-er nichey asi
thhik ase
তারাতারি সিগনেচার করতে গিয়ে ব্যাগ থেকে কলম খুজেঁ পাচ্ছে না। এই আরেক জ্বালা, আমার এই মহা সমুদ্র ব্যাগে কিছু রাখলে দরকারের সময় খুজেঁ লাগানোই মুশকিল। কখনো কখনো ফোন বাজতে থাকলেও খুঁজে হয়রান হই কিন্তু ফোন পায় না। পেতে পেত রিং বাজা সারা হয়ে যায়।
লাফাতে লাফাতে সিড়ি দিয়ে নেমে হাঁটা দিলো ও।মালিবাগ-শান্তিনগরের মোরে এলেই বকুলের কথা মনে পরে যায়! চৈতি জানে এই মনে পড়াটা আলেয়া ছাড়া আর কিছু না। তবুও মনকে মানাতে পারে না। কতোদিন ভেবেছে বকুলকে ওর বউয়ের সাথে নির্ঘাত ওর চোখে পড়বে। পড়েনি। একবারের জন্যে না। মনটা খারাপ লাগছে। কত্তোদিন বকুলের সাথে কথা হয় না!
মোবাইলটাতে বেশি খুজতেঁ হলো না, ডায়াল নাম্বারেই আছে...
আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহুর্তে বন্ধ আছে , আপনার কাঙ্খিত  গ্রাহককে ভয়েস এসএমএস পাঠাতে চাইলে স্টার প্রেস করে গ্রাহকের এগারো ডিজিটের  মোবাইল নম্বরটি ডায়াল করুন। দুই টাকা চার্জ প্রযোজ্য
 হুরর!! অবশ্য বকুলকে ফোন করে এরকম "হুরর" কথাটা চৈতিকে মাঝে মাঝেই বলতে হয়। করার কিছু নেই। মেনে নিয়েছে ও।
রিং বেজে উঠলো, এই রে, সারছে কনক ফোন দিসে, ধরুম না। রিসিভ করলেই ওর বাসায় যাইতে কইবো নিজে নিজেই বলছে। এখন ওরে বুঝাইতেও ইচ্ছে করতাছে না। চামে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে দিলো ও। মোবাইলের রিং শুনলে  অস্থির লাগে। কেউ ফোন দিবে ভয়ে কয়দিন মোবাইলই বন্ধ করে রাখছিলো। ফোন অন করলেই দুনিয়ার মেসেজ আইসা হাজির :(
দুষ্ট একটা হাসি হেসে ফেলে হি হি! একটাও কল ব্যাক করি না। নাম্বার আমার মুখস্ত থাকলেতো করুম কল ব্যাক ;)
মাহিন নিচে দাড়িয়ে আছে, পাশেই দুজন তরুণী নিহার না কি যেন একটা তেলের বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যস্ত। চৈতি খেয়াল করলো মাহিন আড়চোখে ওদের দিকে তাকায় কি না। ধুরর তাকালেই কি-চৈতি নিজেও তো কতোজনের দিকে তাকায়।তবে চোখ লাগে না কাউকেই! ইদানিং ও হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেছে এতোগুলো বছর পার করে শুধু বকুলই কেন ওর চোখ জুরে থাকে। মনে হয় ওর চেয়ে আকর্ষণীয় কোন পুরুষ এই জীবনে দেখেনি। যদিও জানে এটা এই বয়সের ভাবনা হওয়া উচিত না। মাহিনকে কয়দিন বলতে যেয়েও পারেনি।মাহিন এসবে কিছু মনে করে না। জানে ওগুলো চৈতির মনের ঘরেই শিল্পিত থাকে।বাইরের জগতটাকে চৈতি কখনও কলুষিত করে না। সুচিকে বলেছিলো, ওতো হাসতে হাসতেই মরে। অবশ্য চৈতিও মজা করেই বলে এসব।
বেশ কতোগুলো দোকান দেখলো। সত্যিই বেইলী স্টারে এলে অন্তত বেশ কমের মধ্যে ড্রেস পাওয়া যায়। একারণে মাহিন এখানে এলে একসাথে দুই/তিন সেট ড্রেস সবসময়ই কিনে দেয়। একটা ড্রেস দেখেই ওর পছন্দ হয়ে গেল। গাউসিয়ার মতো  বিরক্তিকর কচলাকচলি করতে হয়না। ফিক্সড প্রাইস হওয়ার এই সুবিধাটা সব সময়েই ওর পছন্দ। সবার কেনাকাটা শেষ। ওর মা'র জন্যে ও বরাবরই জামদানী বরাদ্ধ রাখে। কাজেই এবার মায়ের জন্যে...একটা শাড়ী বেশ পছন্দ হলো। ইস! দাম একটুও কমাচ্ছে না। ধুরর! নাহ আরেকটা দোকান থেকে সহজেই মনমতো পাওয়া গেল আরকটা। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফেরা দরকার। মাহিন তারাতারি করে ইফতারের জন্যে একটা কুমির কিনতে গেল, ওহ স্যরি কুমির মানে কুমির সাইজের ব্রেড। পছন্দ হলো না। ফিরে যাচ্ছে বেইলী স্টারের গেরেজের দিকে। চৈতি পিছে পিছে দেখতে দেখতে আসছে। সামনেই পড়লো এক অশিতিপর বৃদ্ধা। ইসস!


মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল-এবার ওর মা'র কথাই আগে মনে পড়লো।যদিও চৈতি ওর মাকে বৃদ্ধ ভাবতে একেবারেই নারাজ। সবাই বললেও কিন্তু ওর মানতে ইচ্ছে করে না। বাবা মারা গেছেন যখন ওর মায়ের বয়স ৩৫ এর কিছু বেশি। সেই মা এতোগুলো বছর বাবার মতো, বন্ধুর মতোই ওদের বড় করেছেন। চৈতি কখনও মানবে না ওর মা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন।নিজেকে সামলাতে না পেরে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে দশটা টাকা আলগোছে ধরিয়ে দিলো। বৃদ্ধা হাসলেন কি না বোঝা গেল না চামড়ার জটিল ভাঁজের কারণে। মার কাছে এবার ঈদের আগে যেতে পাচ্ছি না। ছেলেটাকে খতনা করাতে হলো...বাচ্চা মানুষ, ওর কাছে কাছেই চৈতিকে থাকতে হয়। কিন্তু ওরও যে মায়ের কাছে যেতে মন কাঁদে, ওর মাও যে ওকে দেখতে নিরবে অপেক্ষা করে অভিমান ভরা হৃদয় নিয়ে সেকথা নিজের ভেতরেই গুমড়ে মরছে।
গাড়িতে উঠে দরজা লক করে দিলো। মাহিন বারী সিদ্দিকির গান ছাড়লো "পুবালী বাতাসে, বাদাম দেইখা চায়া থাহি আমার নি কেউ আসে!..." চৈতি নিজেকে আর সামলাতে পাচ্ছে না...চোখের জ্বল বাঁধ মানছে না....



2 মন্তব্য(গুলি):

ভালো লাগলো গল্পটা---
আমার ভিতর থেকেও বেড়িয়ে এলো অসঙ্গায়িত এক 'দীর্ঘশ্বাস'......

আমরা যেন আমাদের আনন্দগুলো দুঃখি মানুষগুলোর সাথেও শেয়ার করে নিতে পারি।
অনেক ধন্যবাদ ইউসুফ আপনাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সোশ্যাল নেটওয়ার্ক

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites